জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)
কোনো জীব থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন (Gene) বহনকারী DNA পৃথক করে ভিন্ন একটি জীবে স্যারের কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। অর্থাৎ, জিন/ ডিএনএ পরিবর্তন করার কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। ১৯৭২ সালে Paul Berg বানরের SV40 lambda virus-এর DNA এর সংযোগ ঘটিয়ে বিশ্বের প্রথম Recombinant DNA (RDNA) তৈরি করেন। তাই Paul Berg কে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক বলা হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত ট্রান্সজেনিক উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী) উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জীবের সব দৃশ্য ও অদৃশ্যমান লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নিরক্ষণকারী এককের নাম জিন। এর অবস্থান ক্রোমোজোমের মধ্যে। ক্রোমোজোমের মধ্যে পেঁচানো চেইনের মতো কিছু বন্ধু থাকে একে ডিএনএ (DNA Deoxyribo Nucleic Acid) বলা হয়। এক জোড়া প্রতিরূপ ক্রোমোজোমে জিন জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। সাধারণত একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট জিন থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও ঘটে থাকে। বিভিন্ন গবেষণার তত্ত্ব থেকে বলা হয়ে থাকে জিনই বংশগতির নিয়ন্ত্রক। মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। এদের মধ্যে একজোড়া ক্রোমোজোম বংশগতির বাহক। একটি ক্রোমোজমে অসংখ্য জিন থাকতে পারে, মানবদেহে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার জিন রয়েছে। আর এই এক সেট পূর্ণাঙ্গ জিনকে জিনোম বলা হয়।
নিচে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অনুসরণকৃত ধাপ সমূহ ব্যাখ্যা করা হলো -
ধাপ-১ কাঙ্ক্ষিত DNA নির্বাচন-
এটি রিকম্বিনেন্ট DNA তৈরির প্রথম ধাপ। কাঙ্ক্ষিত DNA-কে শনাক্ত করে প্রথমে কোষ থেকে DNA আলাদা করা হয়।
ধাপ-২ DNA-এর বাহক নির্বাচন-
নির্বাচিত DNA কে বহন করতে বাহক হিসেবে E. coli ব্যাকটেরিয়াকে নির্বাচন করা হয়। DNA-র সাথে যুক্ত করার জন্য এই বাহকের প্লাজমিডকে ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার দেহে সাধারণ DNA ছাড়াও স্বয়ংক্রিয় বৃত্তাকার যে DNA থাকে, তাই প্লাজমিড।
ধাপ-৩ DNA অণু কর্তন-
রিকম্বিনেন্ট DNA তৈরি করতে নির্বাচিত DNA থেকে সুবিধামত অংশ (Gene) রেস্ট্রিকশন এনজাইমের সাহায্যে কেটে নেওয়া হয়। DNA অণু কাটার জন্য ব্যবহৃত এনজাইমকে “আণবিক কাঁচি” বলা হয়।
ধাপ-৪ কর্তনকৃত DNA অণু প্রতিস্থাপন-
লাইগেজ এনজাইমের সাহায্যে কর্তনকৃত DNA খণ্ডকে বাহক DNA-র নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিস্থাপন করে সংযুক্ত করা হয়।
ধাপ-৫ পোষক দেহ নির্বাচন এবং রিকম্বিনেন্ট DNA স্থানান্তর-
বাহকের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পোষক দেহ নির্বাচন করতে হয়। রিকম্বিনেন্ট DNA অণুকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পোষক ব্যাকটেরিয়ার দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয়।
ধাপ-৬ রিকম্বিনেন্ট DNA-র সংখ্যা বৃদ্ধি-
রিকম্বিনেন্ট DNA হানান্তর করার পর ব্যাকটেরিয়াকে টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধি ঘটানো হয়। এ সময় নির্বাচিত জিন বহনকারী প্লাজমিডও পোষক কোষের সংখ্যার আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যবহারঃ বর্তমান যুগ জীবপ্রযুক্তি তথা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর যুগ। বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ রক্ষা, মানব স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ, শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে।
১. কৃষি উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: একটি উদ্ভিদ এবং উদ্ভিদাংশ হতে অল্প সময়ের ব্যবধানে একই চারা প্রাপ্তি ও সতেজ অবস্থায় স্থানান্তর করা যায়, যে সমস্ত উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে না, তাদের বংশবৃদ্ধি করা সম্ভব। ঋতুভিত্তিক চারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত থাকা যায়। সহজে রোগমুক্ত, বিশেষ করে ভাইরাসমুক্ত চারা উৎপাদন করা সম্ভব। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে টিস্যু কালচার নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত এবং সঠিক বীজ সংগ্রহ ও মজুদ করার সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়। কোনো বন্যজাত এর জিন জগর ফসলী শস্যের মধ্যে সঞ্চালিত করে অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদন করা যায়। যেমন- ধান IRs, IR3s, IR9, গম, পাট, তেলবীজ ইত্যাদি। কৃষি ক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে উৎপন্ন
শস্যকে Genetically Modified Crops (GMC) বলা হয় ।
২. ঔষধ শিল্পে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে ব্যাপকহারে ভ্যাকসিন বা টিকা উৎপাদন করা হচ্ছে যেগুলো পোলিও, যক্ষ্মা,হাম,বসভসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোটিন অণুর সমন্বয়ে গঠিত এ উপাদানটি দেহের রোগ-প্রতিরোধক হিসেবে কার্যকরী। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে বাণিজ্যিক উপায়ে ইন্টারফেরন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এটি হেপাটাইটিস এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার রোগীকে প্রাথমিকভাবে ইন্টারফেরন প্রয়োগ করে ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের হরমোন যেমন ডায়াবেটিস রোগের ইনসুলিন, মানুষের দেহ বৃদ্ধির হরমোন ইত্যাদি উৎপাদন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক।জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত হরমোন সহজসাধ্য এবং দামেও কম হয়। কম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে বর্তমানে এক হাজারের ও বেশি অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদিত হচ্ছে। যেমন- পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, পলিমিক্সিন ইত্যাদি।
৩. গৃহপালিত পশু ও মৎস্য উন্নয়নে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: উন্নতজাতের পশু উৎপাদনের লক্ষ্য হচ্ছে-চর্বিমুক্ত মাংস উৎপাদন,দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি, দ্রুত বৃদ্ধি ও বিক্রয়যোগ্য করা, রোগ প্রতিরোধী এবং কিছু মূল্যবান প্রোটিন উৎপদানসমৃদ্ধ করা। বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক প্রাণী যেমন- শূকর, মুরগী, খরগোশ, গরু, ভেড়া ইত্যাদি তৈরিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য ইতিমধ্যে ট্রান্সজেনিক ভেড়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং- এর মাধ্যমে ভেড়ার দেহের মাংস বৃদ্ধি ও শরীরের পশম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। চর্বিহীন মাংস ও মানুষের হরমোন উৎপাদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রান্সজেনিক শূকর উদ্ভাবন সফল হয়েছে। উদ্ভাবিত হয়েছে ট্রান্সজেনিক ছাগল। ট্রান্সজেনিক গরু উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের মাতৃদুগ্ধের অতি প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ল্যাকটোফেরিনও পাওয়া গেছে। এরপর মাগুর, কৈ, কমনকার্প, লইট্টা এবং তেলাপিয়া মাছে স্যামন মাছের বৃদ্ধি হরমোনের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় এ সকল মাছের প্রজনন প্রায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
৪. দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: দুধের সরাসরি নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও দুধ থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি তৈরি করা হয়। যেমন- দুধ থেকে মাখন, পনির, দই ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করা হয়। দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী তৈরির জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বারা নানা রকমের ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়।
৫. ফরেনসিক টেস্টের ৰেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: রক্ত, বীর্য রস, মূত্র, অশ্রু, লালা ইত্যাদির ডিএনএ অথবা অ্যন্টিবডি থেকে ফরেনসিক টেস্টের মাধ্যমে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়। সেরোলজি টেস্ট দ্বারা মানুষের রক্ত, বীর্য এবং লালাকে চিহ্নিত করে তা ডিএনএ বিশ্লেষণ দ্বারা অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অবদান সম্পর্কে যা জানলাম এগুলো ছাড়াও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে 'হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট এর মাধ্যমে মানবদেহের বিভিন্ন ক্রোমোসোমে অবস্থিত জিনগুলোর অবস্থান ও কাজ সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে মানদেহের ক্ষতিকর জিনকে অপসারণ করে সুস্থ জিন প্রতিস্থাপন করা যায়, একে জিন থেরাপি বলা হয়।
৬. পরিবেশ রৰায় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: পয়ঃপ্রণালী শোধন ও মানুষের মলমূত্র দুর্গন্ধমুক্তরণে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অবদান অপরিসীম। পেট্রোল ও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের গুনাগুণ রক্ষার্থে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন আবর্জনা ও কলকারখানা থেকে নির্গত ময়লা পানির বিষাক্ততা হ্রাসকরণে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ সুরক্ষা এবং রোগাক্রান্ত উদ্ভিদে পেস্টিসাইডের ব্যবহার হ্রাস করার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন রোগের জৈবিক নিয়ন্ত্রণে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিন ব্যাংক স্থাপন করে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা হয় ।
জিন প্রকৌশল বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভয়াবহতার দিকগুলো হলো -
- DNA যদি কোনো কারণে ক্ষতিকর হয়ে পড়ে তাহলে এর প্রভাবে জীব জগতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
- নিবেশিত জিন যদি ক্ষতিকর বা বিষাক্ত প্রোটিন সংশ্লেষণ করে তাহলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন নতুন রোগ সৃষ্টি হতে পারে ।
- যদি কোষে প্রবিষ্ট অ্যান্টিবাক্সোটিক রেজিস্ট্যান্ট জিন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাটেরিয়ায় স্থানান্তরিত হয় তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ঐ রোগজীবাণু দমন করা সম্ভব হবে না।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার :
- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যহৃত বায়োইনফর্মেটিক্স তৈরিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
- গবেষণার তথ্য ও ফলাফল গবেষকদের মধ্যে আদান-প্রদান ও মত বিনিময় করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়।
- বিভিন্ন প্রাণীর জিনের তথ্য এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল সংরক্ষণ করার জন্য ডেটাবেজ ব্যবহৃত হয় ৷
- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহৃত হতে পারে। এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে কম্পিউটার নিসন্নিত বিশেষ সিস্টেম ব্যবহৃত হয়।